নিরাপত্তাহীন কিছু দরিদ্র মানুষের করুণ মৃত্যু
ইমন জামান02/07/20116815
রেটিং:
5
“আমি রাইতে আছিলাম না । আছিল আমার বউ আর পোলা মাইয়া। অহন দেহেন সব ফকফকা। কেউ নাই। আমার মানিকগো কোন চিহ্ন নাই।” রিক্সাওয়ালা বাচ্চুমিয়ার অভিব্যক্তি দেখে কারো বুঝার উপায় নেই, তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আপনজনেরা আর কখনো আসবে না ফিরে। তবু কাছে গিয়ে অভিব্যক্তি জানার চেষ্টা করলে তিনি এভাবেই বেশ শান্ত ভঙ্গিতে কথা ক’টি বললেন। নিয়ে গেলেন স্কুল ঘরে, যেখানে তার স্বজনদের লাশগুলো রাখা আছে। সাদা কাফন উল্টে দেখালেন পাঁচটি তরতাজা লাশ, যেগুলো মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেও জীবন্ত ছিল। তারপর নিজে বলতে শুরু করলেন, আমার বড় মাইয়া শারমিন।
মাত্র পনের দিন আগে তার বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী বহদ্দারহাট থাকে। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মেয়েকে তুলে নিচ্ছে না বলে মেয়ে তার কাছেই থাকে। একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। চাকরি থেকে বুধবার রাত দশটার দিকে ঘরে ফিরে শারমিন। ভোর হতেই সব শেষ। তিনি বললেন, ‘আমার মাইয়া হেগো গরে আর কুনদিন যাইবো না। হেগো বাত আর খাওনের দরকার নাই আমার আম্মার।’ বাচ্চু মিয়ার প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান হওয়ায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন বলে জানালেন। কিন্তু সে সুখও তার কপালে সইলো না।
স্থানীয় বাসিন্দা নীলুফার বেগমের ক্ষোভ অন্যত্র। তিনি বলেন, “মানুষ মরবার লায় ওয়াল দিছে। গরীবরেত এমনে মারতে পারে না। এহন শান্তি অইবো হেগো। আমরা বস্তির মানুষ। বস্তিতই মরুম।” প্রতি বছর এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবু কেন পড়ে আছেন এখানে জানতে চাইলে তিনি এভাবেই তার প্রত্যুত্তর দেন। তার সাথে থাকা রীণা আক্তার বললেন, হারা বছর নেতাগো কোন খবর থাহে না। খালি বিষ্টি এট্টু বেশি অইলে হেরা আসে। খালি কয় সরি যাও, সরি যাও। কই সরি যামু হেইডা কয় না। নীলুফার বলতে থাকেন, ভোডের সময় নেতাগো বেবাকটারে দেহা যায়। কয় এই করুম, সেই করুম। আর কুন খবর নাই। এক ঠেইল্যা পানি কিনতে টেহা লাগে। দুই ঠেইল্যা পানি নিলে তিন টেহা দিতে অয়। নাইলে ধাক্কা মারি সরায় দে।” এ সময় রীণা আক্তার একটু সামলে নিয়ে বলেন, আমগো লাইগা সরকার দেয় ঠিকই, তয় চামচাগুলান খাই ফেলে।”
সফির পরিবারের চার জনের খোঁজ মিলছিল না কিছুতেই। মিনুর বড়বোন জরিনা খাতুন প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন কখন ছোট বোনটিকে একটু দেখবে। স্বেচ্ছাসেবকরা কিছুতেই উপরে যেতে দিচ্ছে না। তাই এক জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। অন্যান্য আত্মীয়স্বজন বলছে, এখানে অপেক্ষা না করে কিছুক্ষণ পর আবার আসতে। দায়িত্বরত সেনা সদস্যও তাঁকে একই অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি নড়লেন না জায়গা থেকে। এক সময় শোনা গেল আরেকটা পাওয়া গেছে। ছুটে গেলেন তিনি। কান্নার বেগও বেড়ে গেল। কিন্তু লাশ নিয়ে আসার পর দেখা গেল এটি তার আপনজনের নয়। আবার ফিরে এলেন পুরনো স্থানে। আবার অপেক্ষার পালা শুরু হলো। সেই অপেক্ষা শেষ হলো সন্ধ্যায়, যখন একই সাথে সফি, মিনু ও তাদের দুই সন্তান সোনিয়া ও মিনহাজকে উদ্ধার করা হলো মাটির নিচ থেকে। মিনুর লাশ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লাশের উপর। যেনবা তার কাছে থাকলে বেঁচে যেত আদরের বোনটি।
এক একটি লাশ আসছে। নিখোঁজ স্বজনদের কারো লাশ ভেবে ছুটে যাচ্ছে অনেকে। আমজাদের পরিবারের তিনজনই মারা গেছে। তার লাশটি উদ্ধারের আরো কিছুক্ষণ পরে উদ্ধার করা হয় তার স্ত্রী রাজিয়া ও মেয়ে শারমিনের লাশ। উদ্ধার কর্মীরা বললেন, মা আর মেয়েকে পাওয়া গেছে জড়াজড়ি অবস্থায়। ধারণা করা হচ্ছে রাতে মায়ের বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল মেয়ে শারমিন। যাতে কোন অশুভ ছায়া মেয়ের গায়ে না পড়ে। মৃত্যুতেও শারমিন যেন তার মায়ের বুকে পেল নির্ভরতা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা এ জাতির বহু পুরনো। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কখনোই এ জাতিকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু গতকাল ভোরে নগরীর বাটালি হিলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য যতোটা প্রকৃতি দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মানুষ। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী অর্থলোভী মানুষের লোভের বলীদান হয়েছে সতেরটি তাজা প্রাণ। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। নিরাপত্তাহীন কিছু দরিদ্র মানুষের করুণ মৃত্যু দেখতে হয় বারবার। ফিরে আসার সময় একজন বলে উঠলো, “আমগো নিয়া লেইখা কুন লাভ নাই। আমগোরে দেহার কেউ নাই। কফালে যা লেখা তাই হইবো।”
আপনার মতামত মতামত পাঠান
Abdul commented on - 7/10/2011 11:01:19 AM
আমার মনেহয় খুব খারাপ।