কোকোর ৬ বছরের জেল

মোহাম্মদ তাজউদ্দিন24/06/20111234 রেটিং: 4

বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া কোকোকে জরিমানা দিতে হবে প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা।সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি টাকার বেশি অর্থের অবৈধ লেনদেনের দায়ে গতকাল বৃহস্পতিবার আদালত এ রায় দিয়েছেন। সিঙ্গাপুর থেকে এই টাকার সমপরিমাণ অর্থ ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতেও আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার বিবরণ অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ খাতে সিমেন্সকে কাজ পাইয়ে দিতে এই অর্থ ঘুষ নিয়েছিলেন আরাফাত রহমান কোকো।

Image

মামলার অপর আসামি সাবেক মন্ত্রী মরহুম লে. কর্নেল আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সায়মনকে একই দণ্ড দিয়েছেন আদালত। আদালত মোট জরিমানা করেছেন ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা কোকো ও সায়মনকে অর্ধেক অর্ধেক করে দিতে হবে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোজাম্মেল হোসেন আসামি কোকো ও সায়মনকে পলাতক দেখিয়ে গতকাল এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, আসামিদের আদালতে হাজির হয়ে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা হাজির হননি। আসামিরা গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণ করার তারিখ থেকে এ রায় কার্যকর হবে। জিয়া পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে এই প্রথম কোনো মামলার রায় দেওয়া হলো। গতকাল দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে রায় ঘোষণা করা হয়। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হট্টগোলের মধ্যেই বিচারক রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়ে শোনান। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ২(ক) আ, ই ১৩ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় দুজনকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবী ‘প্রহসনের রায় মানি না’ বলে আদালতকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল গত বছর ৩০ নভেম্বর। চলতি বছর ৪ জানুয়ারি কোকো পলাতক থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরু হয়। ১৯ জুন যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায়ের তারিখ ধার্য করেন। এর আগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ রাজধানীর কাফরুল থানায় দুদক এ মামলা করে। সিঙ্গাপুরে ২৮ লাখ ৮৪ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার এবং নয় লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ মার্কিন ডলার (সে সময়ের বাজারদর অনুযায়ী ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৮ টাকা) অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর কোকোকে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের মে মাসে তাঁকে সাময়িক মুক্তি (প্যারোল) দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর কয়েক দফা এর মেয়াদ বাড়ানোর পর গত ১৪ আগস্ট প্যারোলের মেয়াদ শেষ হয়। ১৯ আগস্ট প্যারোল বাতিল করে ৩১ আগস্টের মধ্যে দেশে ফিরতে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কোকোর পক্ষে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট ৪০ দিনের জন্য প্যারোলের মেয়াদ বাড়ালেও এর শর্ত ভঙ্গ করায় আপিল বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। এরপর বিচারিক আদালত কোকোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আদালত পরিস্থিতি: গতকাল বেলা ১১টার আগেই আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতকক্ষে জড়ো হন। ১১টা ২০ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। প্রথমেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানি হয়। এ মামলায় আসামিপক্ষ সময়ের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। এরপর আদালত থেকে জানানো হয়, দুপুর ১২টার পর রায় ঘোষণা করা হবে। এ সময় থেকেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতকক্ষের বাইরে ও আদালত চত্বরে মিছিল এবং ‘কোকোর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় প্রহসনের বিচার মানি না’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে আদালত ভবনে আইনজীবীরা দলবদ্ধ হয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে।

Image

গতকাল আদালত এলাকায় নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা। সকাল থেকেই পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন ছিল। কোকোর সাজার রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষের সামনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে আইনজীবীরা জড়ো হতে থাকেন। পরে তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। সমাবেশ থেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ সাজা দেওয়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট ও আইনজীবী সমিতি ভবনের সংযোগ পথে রাখা ফুলের টব ভাঙচুর করেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় তলা থেকে ফুলের টব ছুড়ে ফেলে দিলে নিচে থাকা দুটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা রায়কে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করেন। আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর দুদকের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) সিমেন্সের একটা ঘুষ কেলেঙ্কারি তদন্ত করতে গিয়ে কোকোকে ঘুষ দেওয়ার বিষয়ে তথ্য পায়। সেই কাগজপত্র থেকে শুরু হয় অনুসন্ধান, পরে এজাহার করা হয়। তথ্যটা যেহেতু এফবিআই থেকে প্রাপ্ত, এখানে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বেলা দুইটার দিকে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিজ কক্ষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘সিমেন্স এফবিআইয়ের কাছে দোষ স্বীকার করেছে। আমরা সিঙ্গাপুরে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করেছি। সিঙ্গাপুরের সেই ব্যাংকে কোকোর পাসপোর্টের একটা ফটোকপি দেওয়া হয়েছিল।’ কোকোর সাজা কার্যকর করতে হলে কী করতে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘কোকো বর্তমানে যে দেশে রয়েছেন, সেই দেশের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন চুক্তি থাকলে তা কার্যকর করতে পারে। এটা সরকারের ব্যাপার। আমি মন্তব্য করতে চাই না।’ দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে বলেন, দুদকের ২১ সাক্ষীর জবানবন্দি পর্যালোচনা করে আদালত রায় দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন নিজ কার্যালয়ে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন কোকোর মামলার ত্বরিত নিষ্পত্তির কথা বলেছিলেন, তখনই আশঙ্কা হয়েছিল, ত্বরিত নিষ্পত্তি মানে ত্বরিত শাস্তি। আমাদের সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে।’ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নিম্ন আদালত যখন একটা রায় দিয়েছেন, তখন উচ্চ আদালতেই এর ফয়সালা হবে। এ মামলায় ত্রুটি আছে। তাই আশা করি, উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন কোকো।’ তিনি বলেন, ‘যখন এই মামলা উচ্চ আদালতে আসবে, তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকবে না। তখন দলীয়করণমুক্ত অবস্থায় উচ্চ আদালত ন্যায়বিচার করতে পারবেন বলে আমরা আশা করি।’ কোকোর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া, গোলাম মোস্তফা খান ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার একে প্রহসনের রায় উল্লেখ করে রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। মামলার বিবরণ: মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, কোকোর দেওয়া আয়কর বিবরণী ও দুদকে দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে সিঙ্গাপুরে তাঁর হিসাবে অর্থ জমা বা উত্তোলনের কোনো উল্লেখ নেই। সিঙ্গাপুরে জ্যাজ ট্রেডিং অ্যান্ড কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড এবং ফারহিল কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে কোকোর দুটি কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা হওয়ার সময় তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যেসব সূত্র থেকে অর্থ জমা হয়েছে তাদের সঙ্গে কোকোর কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কও ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি অবৈধ উপায়ে এ অর্থ আয় করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, ইউওবি ব্যাংকের জ্যাজের হিসাবে ২০০৫ সালের ৬ মে এবং ৩১ মে নয় লাখ ২০ হাজার ৯৮৬ দশমিক ৫৭ এবং আট লাখ ৩০ হাজার ৬৫৬ দশমিক ৭৭ সিঙ্গাপুর ডলার জমা হয়। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি থেকে এই অর্থ পাঠানো হয়। একই বছরের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক থেকে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাঠানো হয় আরও আট লাখ ২৯ হাজার ৭০৫ দশমিক ৮১ সিঙ্গাপুর ডলার। এর বাইরে জ্যাজের হিসাবে ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর আবারও এক লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার (তিন লাখ তিন হাজার ২৫৪ সিঙ্গাপুর ডলার) জমা হয়। ওই অর্থ জুলফিকার আলী নামের এক ব্যক্তি সিঙ্গাপুরের আরেকটি ব্যাংকের হিসাব থেকে হস্তান্তর করেন। জুলফিকার আলী টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিমেন্সের পরামর্শক। সিমেন্স বাংলাদেশকে তিনি রাষ্ট্রীয় মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান টেলিটকের কাজ পাইয়ে দিতে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন। টেলিটকের কাজ পেতে সিমেন্স কোকোসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের যে ঘুষ দিয়েছিল, তা প্রমাণিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে জরিমানার রায় দেন। জরিমানার অর্থ পরিশোধও করেছে সিমেন্স। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, জ্যাজের হিসাব থেকে বিভিন্ন দফায় কোকোর সইয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। হিসাবে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৫৪ দশমিক ১৫ সিঙ্গাপুর ডলার জমার বিপরীতে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে আট লাখ ৭২ হাজার ৮৬ দশমিক ৭৭ সিঙ্গাপুর ডলার উত্তোলন করেন কোকো। ২০০৫ সালের ২৯ জুলাই আট লাখ ৩০ হাজার ৬৫৬ দশমিক ৭৭ সিঙ্গাপুর ডলার ইসমাইল হোসেনকে দেওয়া হয়। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগে ২২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাটকো, নাইকো, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ-সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১২টি মামলা রয়েছে। তারেকের বিরুদ্ধে করা অর্থ পাচারের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৭ জুলাই দিন ধার্য রয়েছে। বাকি মামলাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

Image



আপনার মতামত মতামত পাঠান

মতামত পাঠান

Close comment

* আপনার নাম:
* ই-মেইল::
টাইপিং সিলেক্ট করুন:
* মতামত:
Enter code here:
Security Code: